"শিশুদের সচেতন করে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়"
দেশে বেড়েই চলছে শিশু যৌন নিপীড়ন ও নারী হয়রানি। এ বিষয়ে শিশু ও নারীদের সচেতন করাই এই ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’র কাজ। তারা কাজ করে মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়। বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন রেদওয়ানুল হক ও নাজমুল মৃধা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’। তাদের স্বপ্ন সমাজ থেকে চিরতরে শিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতন দূর করা। এ লক্ষ্যেই মন-প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটির সদস্যরা।
‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’র পথচলা খুব বেশিদিন হয়নি। তবে শিশু যৌন নিপীড়ন ও নারী হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে এরই মধ্যে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে কোমলমতি শিশুদের নিয়ে ‘নিরাপদ শৈশবের সন্ধান’ নামে কর্মশালার আয়োজন করছেন। সেখানে শিশুদের শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর সঙ্গে পরিচিত করা, ভালো ও খারাপ উদ্দেশ্যে স্পর্শের মধ্যে পার্থক্য বোঝানো, কে বা কারা প্রয়োজনে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো স্পর্শ কিংবা দেখতে পারে (যেমন—ডাক্তার, মা-বাবা), কেউ খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে স্পর্শ করলে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়—এসব বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন শিশুদের।
রাজশাহীর ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচ থেকে ১১ বছরের শিশুদের নিয়ে কর্মশালা করা হয়েছে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথশিশুদের স্কুল ‘ইচ্ছা’য় কর্মশালা শুরু হয়। বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সংগঠনটি ৪০০ শিশুর ওপর একটি প্রাথমিক জরিপ চালায়। তাদের এই জরিপে দেখা গেছে, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪০ শতাংশ শিশুই কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।
মূলত অভিভাবকদের সচেতন করতেই এই জরিপ।
যেসব স্কুলে এ কর্মশালা করা হয়েছে, সেসব স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের অনেকেই শিশু নিপীড়ন বলতে শুধু ধর্ষণকেই বুঝতেন। কিন্তু এখন তাঁদের ধারণা পাল্টেছে। একবার এক স্কুলে প্রশিক্ষণ শুরু করার আগ মুহূর্তে কয়েকজন শিক্ষক প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বলছিলেন, শিশুদের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলা অনুচিত। তখন সংগঠনের সদস্যরা কর্মশালায় শেষ অবধি থাকার জন্য তাঁদের অনুরোধ করেন। পরে শিক্ষকরা রাজি হন। কর্মশালা শেষে তাঁরা জানালেন, এত দিন তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। এ ধরনের কর্মসূচি শিশু ও অভিভাবক উভয়ের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরা বলেছিলেন, তাঁরা এখন থেকে নিজস্ব উদ্যোগে স্কুলে শিশু ও অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করবেন।
কর্মশালা থেকে শিক্ষা নেওয়া শিশুরা এখন সংকোচ ও দ্বিধা ছাড়াই তাদের অভিভাবকের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলতে শিখেছে। অনেক অভিভাবকই পরে জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণের পর তাঁদের সন্তানরা নিজেদের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। অভিভাবকরাও সন্তানদের এ ধরনের সমস্যাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া রিমা নামের এক শিশু শিক্ষার্থী বলছিল, ‘কর্মশালা থেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আগে কেউ এসব শেখায়নি, এমনকি মা-বাবাও কিছু বলেননি। এখন আরো ছোটদেরও এসব বিষয়ে সচেতন করতে পারব। ’
এখানেই থেমে নেই সংগঠনটির কার্যক্রম। গণপরিবহনে যেন কোনো নারী হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য রাজশাহীর ৮০টি বাসে স্টিকার লাগিয়েছেন। স্টিকারে নারীর পাশে কোনো পুরুষের দাঁড়ানোর ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখা, হয়রানি প্রতিরোধে আইনি সহায়তাপ্রাপ্তির নম্বরও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সংগঠন শুরুর ব্যাপারে প্রতিষ্ঠাতা নওরীন আমিনা বলছিলেন, “বিভিন্ন সময়ে সমাজে ঘটে যাওয়া শিশু যৌন হয়রানি অন্যদের মতো ভাবিয়ে তোলে আমাকেও। কিভাবে শিশুদের এসব বিষয়ে সচেতন করা যায়, তা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। বন্ধু রায়হান, রুহুল ও মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তারা উত্সাহ দিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে গড়ে তুললাম ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’। যার পথচলা শুরু চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ” মাত্র আটজন সদস্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে সংগঠনটি। বর্তমানে সদস্যসংখ্যা ৩০। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী। শুরু থেকে সদস্যদের মাসিক চাঁদা এবং সংগঠনের উপদেষ্টাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
গত ১৯ জুলাই ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’র আরেকটি শাখা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা করেছে। আগামী দিনে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরুর কথা ভাবছেন নওরীন আমিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের প্রতিটি স্কুলের শিশুদের কাছে পৌঁছতে চাই। আমরা চাই প্রতিটি শিশু সচেতন হয়ে উঠুক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশ উত্সাহ পেয়েছি। ভবিষ্যতে এই সংগঠনের কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে এবং সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে চাই।
Source: kaler kantho